মনোতোষ সরকারঃ রায়গঞ্জ-শিলিগুড়িঃ পশ্চিমবঙ্গের বহুদিন আগে থেকেই একটি উল্লিখিত নাম উত্তরবঙ্গ। এইভাবে কথিত যে গঙ্গার এপার থেকে উত্তরবঙ্গ গঙ্গার ওপরটা দক্ষিণবঙ্গ। সুতরাং বলাইবাহুল্য গঙ্গার এপারে জেলাগুলো নিয়ে উত্তরবঙ্গ আর গঙ্গার ওপারে জেলাগুলো নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ।
উত্তরবঙ্গের উপর থেকেই আসা যাক দার্জিলিং একটি ছোট্ট জেলা পাহাড়ে আবৃত, এখানকার মানুষরা কষ্টসহিষ্ণু, সেরকম কোন শিল্প একটি চা শিল্প ছাড়া আর কিছু নেই। তারপরে আসা যাক কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুর ও মালদা জেলার কথায়। এই জেলাগুলির বেশিরভাগই নদী-নালা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংলগ্ন। এই জেলাগুলি অধিকাংশই কৃষিনির্ভর এবং কৃষিকাজ'ই হলো এই জেলাগুলির মানুষের প্রধান জীবিকা।
পশ্চিমবাংলার উত্তর দিনাজপুর জেলার গ্রামভিত্তিক শহর রায়গঞ্জ ও জেলা সদর শহরও বটে। পাশে ঘেঁষে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। চারিদিক গ্রামবেষ্টিত এই রায়গঞ্জ শহর। এই রায়গঞ্জ শহরের বুক চিরে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ও একটি মাত্র রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর একটি মাত্র ট্রেন, যা রাধিকাপুর থেকে কলকাতা যায় প্রত্যহ।
বিগত দিনে এই রায়গঞ্জ শহরে 'এইমস' হাসপাতাল স্থাপনের জন্য ভারতের প্রাক্তন তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও রায়গঞ্জের তৎকালীন সাংসদ প্রয়াত শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি মহাশয় উত্তরবঙ্গের জনসাধারণের চিকিৎসার স্বার্থে 'এইমস' এর মত এক বিশাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সংসদে সেই বিল পাশও হয়ে যায়, অর্থমন্ত্রক এর জন্য পরিকল্পনামাফিক টাকাও ধার্য করে। কিন্তু তৎকালীন রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণে গড়িমসি করেন ও 'এইমস' হাসপাতাল মিথ্যা প্রচার বলে উড়িয়ে দেন। এমনকি কাউকে বলতেও দেখা যায় জনসমক্ষে, এ হচ্ছে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ভাওতাবাজি, আদৌ এইমস হয়নি।
তারপরে এল লোকসভা ভোট। লোকসভা ভোটের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সরকার পরিবর্তন হয়ে যায়। বর্তমান সরকার জানায়, উত্তরবঙ্গে তথা রায়গঞ্জের পানিশালায় এইমস গড়ে উঠবার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই, তাই নানা অছিলায় রায়গঞ্জের মানুষকে বঞ্চিত করে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি কিংবা কোচবিহার জেলার যে কোনো স্থানে স্থাপন না করে সোজা নিয়ে যায় কল্যাণীতে। উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের পানিশালায় প্রস্তাবিত এইমস হাসপাতাল স্থাপনের জন্য ও জমি অধিগ্রহনের দাবীতে প্রায় শতাধিক কৃষক স্বেচ্ছায় জমি দান করবার আন্দোলনও করে। কিন্তু কে কার কথা শুনে।
এই এইমস হাসপাতাল উত্তরবঙ্গে স্থাপন হলে শুধু উত্তরবঙ্গের নয় সারা পূর্ব ভারতের মানুষ এক উন্নতমানের চিকিৎসার সুযোগ পেতেন। এছাড়াও পার্শ্ববতী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের মানুষরাও উপকৃত হতেন এবং সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের মানুষের সার্বিক চেহারা ও জীবনযাপনের মান কিছুটা হলেও পাল্টে যেত। উন্নয়ন হত এলাকার, তৈরি হতো অনেক অনুসারী শিল্প, যেগুলো দিয়ে উত্তরবঙ্গবাসির রুজি-রোজগারের পথ প্রশস্ত হতই।
তাহলে তৎকালীন সরকার রায়গঞ্জের পানিশালায় এইমস স্থাপনের জন্য সরকারিভাবে কিভাবে মঞ্জুর করেছিলেন? তারা কি সবাই অন্ধ ছিলেন! নাকি গাঁজা খেয়ে নির্বাচন করেছিলেন!
তাহলে এখানে একটি কথা আসে না? একই দেশে বাস করে, যেখানে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবেশ, যেখানকার মানুষ দিন এনে দিন খায়, সেখানে কি উন্নয়নমূলক কোন কাজ করা যায় না?
আবার রায়গঞ্জবাসী একটি ট্রেন 'কলকাতা থেকে রাধিকাপুর' প্রতিদিন সকালবেলার যাতায়াতের জন্য ভারতীয় রেল দপ্তরের কাছে আবেদন ও দাবি করে। বহু নেতা-নেত্রী রায়গঞ্জবাসীর এই আবেদনে সাড়া দিলেও এই ট্রেন-এর ব্যাপারে রেলমন্ত্রক কোন সাড়া দেয়নি।
অবশেষে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, একটি লিংক ট্রেন বালুরঘাট এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে জুড়ে দেবে মালদার একলাখি স্টেশনে, তারপরে সেটা কলকাতা যাবে। এই খবর জানাজানি হতেই দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিশাল তৎপরতা, শুরু হয়ে যায়, যে কারা এই ট্রেন দাবি করে নিয়ে আসলো। রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, করণদিঘি, ডালখোলা ও ইটাহারের জনগণের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছিল এবং অনেককেই বলতে দেখা যায়, যাক এখন সকাল বেলা একটা ট্রেন হল যাতে চেপে আমরা দিনের বেলায় কলকাতায় পৌঁছাতে পারবো, আবার সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে আসতে পারবো। অবশেষে সেই আশাও এখন বিশবাঁও জলে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায় লিংক ট্রেনের যে সম্ভাবনা ছিল, এবং রেল দপ্তরের সঙ্গে যে কথা চলাচলি হচ্ছিলো সেটা বাতিল হয়ে গেছে।
পশ্চিমবাংলা স্বাধীনতার পর থেকেই অবহেলিত। অথচ, এই বাংলা-ই একসময় ভারতের রাজধানী ছিল। আবার পশ্চিমবাংলার উত্তরবঙ্গ তথা উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি চিরকালই অবহেলিত, লাঞ্ছিত এবং তিরস্কৃত। অথচ এই উত্তরবঙ্গ থেকেই বৃহত্তর চা শিল্প যা ভারত থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হয় এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জিত হয়। এই চা শিল্পকে কেন্দ্র করেই উত্তরবঙ্গে বিশাল শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার পরিকল্পনা করা যেতে পারত কিন্তু তা না করে এই শিল্পটাকে ধ্বংস করে দেওয়ার একটা চক্রান্ত চলছে। চাশিল্পের মালিকরা বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। দেখা গেছে সরকারি উদাসীনতা।
বাম আমলেও সেরকম কিছু নজির নেই যা তারা দেখাতে পারবেন। চর্ম নগরী, সুতা শিল্প সবই হাওয়া, এখন বিশবাও জলে।
বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে উত্তরবাংলার জন্য কিছু চিন্তাভাবনা হয়েছিল স্কুল, কলেজ ও স্বাস্থ্য দপ্তরের। কোথাও কোথাও স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু হয়েছিল, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং এর বিভিন্ন স্থানে সরকারিভাবে কিছু জমি অধিগ্রহণ করেছিল। যেগুলোতে প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে এবং জেলার উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু বিধান রায় চলে গেলেন, তার পরেই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন নজির।
উত্তরবঙ্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস ও সাহিত্যের আলোকে অবিভক্ত, কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই উত্তরবঙ্গের জন্য যখনই কোনও বিশেষ করে সরকারি প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, তখনই রাজনীতির খেলা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। এই খেলা উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে যেন চিরকালীন রেওয়াজ হয়েই গিয়েছে। চোখের সামনে এইমস উত্তরবঙ্গ থাকে বিদায় হয়েছে, সার্কিট হাউস হয়েও হচ্ছে না, জাতীয়সড়ক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, ডালখোলা বাইপাস অন্ধকারে, ডালখোলা রেলগেটে আন্ডারপাস না হওয়াতে প্রতিদিন কয়েক শত যানবাহন আটকে, ডালখোলা থেকে রায়গঞ্জ জাতীয় সড়কে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে রাস্তা বেহাল হওয়ার জন্য। তা ছাড়াও জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের কাছে তিস্তার উপরে দ্বিতীয় রেলসেতু এবং নিউ ময়নাগুড়ি-যোগীঘোপা রেল যোগাযোগ সবই রাজনৈতিক জোটে অবরুদ্ধ। তারপরে শেষ সংযোজন স্মার্ট সিটির তালিকা থেকে শিলিগুড়িকে বাতিল করে দেওয়া।
উত্তরবঙ্গ তথা অবহেলিত উত্তর দিনাজপুরের মানুষ জানে। স্বাধীনতার পর এখানকার বলতে রায়গঞ্জের মানুষদের সাংসদ হওয়ার মতন নাকি কোন যোগ্যতাই ছিল না, এবং যোগ্যতা থাকলেও তাদের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। যার জন্য দক্ষিণবঙ্গ বা বিভিন্ন জায়গা থেকে থেকে লোক ধার করে এনে লোকসভায় বা বিধানসভায় প্রার্থী করা হতো। উল্লেখ্য বর্তমানেও রায়গঞ্জের যে সাংসদ আছেন তিনিও কলকাতার।
এইরকম একটি অবহেলিত এলাকার মানুষের জন্য আর কেই-বা ভাববে। তাই এখানকার মানুষ যতই, আবেদন-নিবেদন করুক না কেন এখানে কোন কিছুই হবার নয়। এটাই বাস্তব। এখানকার মানুষদের এটাই এখন বুঝে নেওয়া উচিত যে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করা বন্ধ করে দেওয়া দরকার।
ভোট আসলে নেতারা এসে হাত জোড় করে ভোট চাইবেন, সবকিছু হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেবেন। আর উত্তরবঙ্গের মানুষেরা তাদেরকে দুহাত উজাড় করে ভোট দিয়ে দিবেন।
তারপরে সেই মহান ও মহামান্যরা সাংসদ নির্বাচিত হয়ে হবেন পরিযায়ী পাখি, এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা, তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যাবেন। এতদিন ধরে আমরা যেটা দেখে এসেছি বা দেখতে পাচ্ছি সবটাই মিলে যাচ্ছে বা সঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবঙ্গে এখন যে দলবদলের রাজনীতি দেখতে পাচ্ছি, তাতে উন্নয়নের রাজনীতি, দেশের জন্য রাজনীতি, দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি, দেশের মানুষের উপকারের জন্য রাজনীতি কতটা বাস্তবসম্মত। সেটা সময়ই কথা বলবে।
তাহলে উত্তরবঙ্গের জনগণ তথা রায়গঞ্জের মানুষদের ভেবে নেওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? আর যাই হোক না কেন, এখানে যারা নির্বাচিত হন বা ভোটে জেতেন তাদের কথাকে ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে। উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন এখন প্রাসঙ্গিক।
No comments:
Post a Comment